কুরআন ও হাদীসের আলোকে দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব|| এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল

বিষয়ঃ কুরআন ও হাদীসের আলোকে দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব 


[ ] 'দাওয়াত' আরবী শব্দ যার অর্থ ডাকা বা আহবান করা। দাওয়াতে দীনের সারকথা হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান তথা দ্বীন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে মানুষদের আহ্বান করা।আমরা আজকে কুরআন ও হাদীসের আলোকে দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ।। 


[ ] দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্বঃ 

দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব দুভাগে আলোচনা করা যেতে পারে- 

১. বিধানগত গুরুত্ব 

২. ফলাফলগত গুরুত্ব


[ ] দাওয়াতে দ্বীনের বিধানগত গুরুত্বঃ 

• পৃথিবীতে আল্লাহ কর্তৃক যত শরীয়ত প্রবর্তিত হয়েছে এবং সকল শরীয়তের প্রধান বাস্তবায়ন কারীগন তথা সকল নবী রাসূলদের প্রধান কাজই ছিলো দাওয়াতে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার। 

দাওয়াতে দ্বীনের প্রচার বা আল্লাহর বাণী পৌঁছানোই রাসূলগণের একমাত্র দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

فَهَلۡ عَلَى ٱلرُّسُلِ إِلَّا ٱلۡبَلَٰغُ ٱلۡمُبِينُ

“রাসূলগণের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা।” [সূরা আন-নাহল, ৩৫]


নূহ (আ) এর দাওয়াত- 

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ إِنِّيَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

"নিশ্চয় আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। আমি তোমাদের জন্যে একটি মহাদিবসের শাস্তির আশঙ্কা করি"। [আরাফ-৫৯]


নূহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে:

أُبَلِّغُكُمۡ رِسَٰلَٰتِ رَبِّي وَأَنصَحُ لَكُمۡ

“আমি আমার রবের রিসালাতের দায়িত্ব তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের নসীহত করছি।” [আল-আ‘রাফ-  ৬২]


হুদ (আ) এর দাওয়াত-

وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُوداً قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ أَفَلاَ تَتَّقُونَ

"আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোন উপাস্য নেই"। [আরাফ-৬৫]


সালেহ (আ) এর দাওয়াত- 

وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ

সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতিত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। [আরাফ-৭৩]


শোয়াইব (আ) এর দাওয়াত- 

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَـهٍ غَيْرُهُ 

আমি মাদইয়ানের প্রতি তাদের ভাই শোয়ায়েবকে প্রেরণ করেছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই। [আরাফ-৮৫]


মূসা (আ) এর দাওয়াত- 

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآيَاتِنَا أَنْ أَخْرِجْ قَوْمَكَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَذَكِّرْهُمْ بِأَيَّامِ اللّهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُورٍ

'আমি মূসাকে নিদর্শনাবলী সহ প্রেরণ করেছিলাম যে, স্বজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনয়ন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিনসমূহ স্মরণ করান। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে'। [ইবরাহিম-৫]


একইভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বশেষ এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা মুহাম্মদ (স) কর্তৃক বাস্তবায়িত হয়েছে। সে ব্যাপারেও আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ (স) কে একই নির্দেশনা দিয়েছেন।


মুহাম্মদ (স) কে অন্যান্য নবীদের কর্মপ্রক্রিয়া স্মরন করে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِۦ نُوحٗا وَٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَمَا وَصَّيۡنَا بِهِۦٓ إِبۡرَٰهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰٓۖ أَنۡ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُواْ فِيهِۚ كَبُرَ عَلَى ٱلۡمُشۡرِكِينَ مَا تَدۡعُوهُمۡ إِلَيۡهِ


“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করো না। আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহ্বান করছেন তা তাদের নিকট দুর্বহ মনে হয়।” [সূরা আশ-শুরা- ১৩]


রাসূল (স) কে দাওয়াতে দ্বীনের তাগিদ দিয়ে আল্লাহ বলেন- 

يَٰٓأَيُّهَا ٱلرَّسُولُ بَلِّغۡ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ مِن رَّبِّكَۖ وَإِن لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَهُ

“হে রাসূল! আপনার রবের পক্ষ থেকে আপনার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না।” [আল-মায়েদাহ- ৬৭]


নবী রাসূলগনের মূল কাজই ছিলো দাওয়াত- 

ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلرَّسُولَ ٱلنَّبِيَّ ٱلۡأُمِّيَّ ٱلَّذِي يَجِدُونَهُۥ مَكۡتُوبًا عِندَهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ يَأۡمُرُهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَىٰهُمۡ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ


“যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মি নবীর, যাঁর উল্লেখ তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জীলে লিপিবদ্ধ পায়, যিনি তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন।” [আল-আ‘রাফ- ১৫৭]


আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- 


يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّر

قُمْ فَأَنذِرْ

وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ

'হে চাদরাবৃত! উঠুন, সতর্ক করুন, আপন পালনকর্তার মাহাত্ম্য ঘোষনা করুন'। [মুদ্দাসিসর ১-৩]


يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا


হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। [আহযাব-৪৫]


قُلْ هَـذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَاْ وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللّهِ وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

বলে দিনঃ এই আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝে সুঝে দাওয়াত দেই আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র। আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই। [ইউসুফ-১০৮]



إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خلَا فِيهَا نَذِيرٌ

আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ পাঠিয়েছি সংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাতে সতর্ককারী আসেনি। [ফাতির-২৪]


فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءهُمْ 

সুতরাং আপনি এর প্রতিই দাওয়াত দিন এবং হুকুম অনুযায়ী অবিচল থাকুন; আপনি তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করবেন না। [শূরা-১৫]


এভাবে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে দাওয়াতে দ্বীনের পথে মুহাম্মদ (স) সহ সকল নবী রাসূলের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বর্ণনা করেছেন।


উম্মতে মুহাম্মদী হিসেবে এবং আকীদা বিশ্বাসে সকল নবী রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী হিসেবে আমাদের ওপরও দাওয়াতে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ ব্যক্তিগতভাবেই দাওয়াতে দ্বীনের কাজ সকল মুমিনের ওপর ফরজে আইন।


আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

وَمَنۡ أَحۡسَنُ قَوۡلٗا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ 

“ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন।” [সূরা হা-মিম সাজিদাহ- ৩৩]

নবুয়তের ৩য় বছর শেষে প্রকাশ্যে দাওয়াতের অনুমোদন দিয়ে আল্লাহ তায়ালা অত্র আয়াতটি নাজিল করেন।


উম্মতে মুহাম্মাদির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো দাওয়াতে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার- 


আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ 


“আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহ্বান করবে, ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।” [আলে ইমরান- ১০৪]


আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,


كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ وَلَوۡ ءَامَنَ أَهۡلُ ٱلۡكِتَٰبِ لَكَانَ خَيۡرٗا لَّهُمۚ مِّنۡهُمُ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَأَكۡثَرُهُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ


“তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায়কার্যে আদেশ এবং অন্যায় কাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস কর।” [ আলে ইমরান-১১০]


প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে দাওয়াতে দ্বীনের পথে নিজেকে উৎসর্গ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- 


يُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُسَٰرِعُونَ فِي ٱلۡخَيۡرَٰتِۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ مِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ 

“তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত।” [ আলে ইমরান-১১৪)


আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,


وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتُ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلِيَآءُ بَعۡضٖۚ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٞ 


“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [আত-তাওবাহ- ৭১]


আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- 

وَالْعَصْرِ

إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ

إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ

কসম যুগের (সময়ের)। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের। [আছর ১-৩]


রাসূল (স) বলেন- 

ألا كُلُّكُمْ راعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ

“সাবধান! তোমরা সকলেই অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। 


আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (স) বলেন- 

بلغوا عني ولو اية 

একটি আয়াত হলেও তা আমার পক্ষ থেকে প্রচার করো। (বুখারী) 


আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (স) আরো বলেন- 

«مَنْ رأي منْكُمْ مُنْكَرًا فلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَانْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَانْ لَمْ يَسْتِطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أضْعَفُ الْايْمَانِ»

“তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখতে পায় তবে সে তাকে তার বাহুবল দিয়ে প্রতিহত করবে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে তার বক্তব্যের মাধ্যমে (প্রতিবাদ) তা পরিবর্তন করবে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তা হলে অন্তর দিয়ে তার পরিবর্তন (কামনা) করবে। আর এটা হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।” (মুসলিম) 


দাওয়াতে দ্বীনের গুরুত্ব এতই অধিক যে, ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরেও এটিই হবে মুমিনের প্রধান কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- 


ٱلَّذِينَ إِن مَّكَّنَّٰهُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ أَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَمَرُواْ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَنَهَوۡاْ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۗ وَلِلَّهِ عَٰقِبَةُ ٱلۡأُمُورِ 


“যাদেরকে আমরা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে বা ক্ষমতাবান করলে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, সৎকাজে নির্দেশ দেয় এবং অসৎকাজে নিষেধ করে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে।” [আল-হাজ- ৪১]


শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী তার ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন বইয়ে - জিহাদ বা ইসলামী আন্দোলনের ৫ টি স্তরের মধ্যে 'দাওয়াতে ইলাল্লাহ' কে সর্বাগ্রে আলোচনা করেছেন।


অতএব দাওয়াতে দ্বীনকে ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মানতে হবে, এবং তার প্রসারে আত্মনিয়োগ করতে হবে।


[ ] ফলাফলগত গুরুত্বঃ

এখানে আমরা দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করলে কি লাভ হবে, এবং তা অবহেলা করলে বা দাওয়াতে দ্বীনের কাজ না করলে কি ক্ষতি হবে তা আলোচনা করবো।


দাওয়াতে দ্বীন ও সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দায়িত্ব যারা পালন করবে তাদের পুরষ্কারের ঘোষনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

لَّا خَيۡرَ فِي كَثِيرٖ مِّن نَّجۡوَىٰهُمۡ إِلَّا مَنۡ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوۡ مَعۡرُوفٍ أَوۡ إِصۡلَٰحِۢ بَيۡنَ ٱلنَّاسِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِ فَسَوۡفَ نُؤۡتِيهِ أَجۡرًا عَظِيمٗا 


“তাদের গোপন পরামর্শের অধিকাংশে কোনো কল্যাণ নেই। তবে (কল্যাণ আছে) যে নির্দেশ দেয় সদকা কিংবা ভালো কাজ অথবা মানুষের মধ্যে মীমাংসার। আর যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে করবে তবে অচিরেই আমরা তাকে মহাপুরস্কার প্রদান করব।” [আন-নিসা- ১১৪]


হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (স) বলেন- 

وَاللهِ لأنْ يَهْدِيَ اللهُ بِكَ رَجُلاً وَاحِدًا خَيرٌ لَكَ مِنْ أنْ يَكُونَ لَكَ حُمْرُ النَّعْمِ»


“আল্লাহর কসম, তোমার মাধ্যমে যদি একজন মানুষকেও আল্লাহ সুপথ দেখান তাহলে তা তোমার জন্য (সর্বোচ্চ সম্পদ) লাল উটের মালিক হওয়ার চেয়েও উত্তম বলে গণ্য হবে'। (মুসলিম) 


সহীহ মুসলিমের অপর এক হাদীসে রাসূল (স) বলেন- 

«مَنْ دَعَا إلى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الْاجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لا يَنْقُصً ذلِكَ مِنْ أُجُرِهِمْ شَيئاً وَمَنْ دَعَا إلى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْاثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لايَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيئًا».


“যদি কোনো ব্যক্তি কোনো ভালো পথে আহ্বান করে, তবে যত মানুষ তার অনুসরণ করবে তাদের সকলের পুরস্কারের সমপরিমাণ পুরস্কার সে ব্যক্তি লাভ করবে, তবে এতে অনুসরণকারীদের পুরস্কারের কোনো ঘাটতি হবে না। আর যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিভ্রান্তির দিকে আহ্বান করে তবে যত মানুষ তার অনুসরণ করবে তাদের সকলের পাপের সমপরিমাণ পাপ সে ব্যক্তি লাভ করবে, তবে এতে অনুসরণকারীদের পাপের কোনো ঘাটতি হবে না।” (মুসলিম) 


হযরত আবু মাসউদ বাদরী (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (স) বলেন- 

من دل علی خير فله مثل اجر فاقم عله 

'কেউ যদি কোন ভালো কাজের পথ দেখায় তবে ঐ কাজ যে ব্যক্তি নিজে করল তার সমান সে সওয়াব পাবে।' (তিরমিযী) 


রাসূল (স) আরো বলেন- 

أمْرُ بِالمَعْرُوفِ صَدَقَةٌ وَنَهيٌ عَنِ الْمُنْكَرِ صَدَقَةٌ


“ভালো কার্যে নির্দেশ করা সদকা বলে গণ্য এবং খারাপ থেকে নিষেধ করা সদকা বলে গণ্য।(মুসলিম) 


আনাস ইবনে মালিক (রা) হতে বর্ণিত। রাসূল (স) বলেন, আল্লাহর পথে একটি সকাল ও একটি বিকেল ব্যয় করা দুনিয়া ও এর সমস্ত সম্পদ থেকে উত্তম। ( বুখারী) 


দা‘ওয়াত ও আদেশ নিষেধের দায়িত্ব পালন করার অন্যতম পুরস্কার হলো জাগতিক গযব থেকে রক্ষা পাওয়া। (সহীহ বুখারী ও তিরমিজিতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে) 


আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলন, আমি রাসূল (স) কে বলতে শুনেছি- আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তির মুখ উজ্জল করুন, যে আমার কোন হাদীস শুনেছে এবং যেভাবে শুনেছে সেভাবেই অপরের নিকট পৌছিয়ে দিয়েছে। ( তিরমিজী) 




দাওয়াতে দ্বীনের কাজে অবহেলার শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

وَإِذۡ قَالَتۡ أُمَّةٞ مِّنۡهُمۡ لِمَ تَعِظُونَ قَوۡمًا ٱللَّهُ مُهۡلِكُهُمۡ أَوۡ مُعَذِّبُهُمۡ عَذَابٗا شَدِيدٗاۖ قَالُواْ مَعۡذِرَةً إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَّقُونَ ١٦٤ فَلَمَّا نَسُواْ مَا ذُكِّرُواْ بِهِۦٓ أَنجَيۡنَا ٱلَّذِينَ يَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلسُّوٓءِ وَأَخَذۡنَا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ بِعَذَابِۢ بَ‍ِٔيسِۢ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ 


“আর স্মরণ কর, যখন তাদের একদল বলল, তোমরা কেন উপদেশ দিচ্ছ এমন কওমকে, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করবেন অথবা কঠিন আযাব দেবেন? তারা বলল, তোমাদের রবের নিকট ওযর পেশ করার উদ্দেশ্যে। আর হয়তো তারা তাকওয়া অবলম্বন করবে। অতঃপর যে উপদেশ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, যখন তারা তা ভুলে গেল তখন আমরা মুক্তি দিলাম তাদেরকে যারা মন্দ হতে নিষেধ করত। আর যারা যুলুম করেছে তাদেরকে কঠিন আযাব দ্বারা পাকড়াও করলাম। কারণ তারা পাপাচার করত। [আল-আ‘রাফ, ১৬৪-১৬৫]


রাসূল (স) বলেন- 

إنَّ النَّاسَ إذَا رأوا الْمُنْكَرَ لا يُغَيِّرُونَهُ أوشَكَ أنْ يَعُمَّهُمُ اللهُ بعقَابِهِ»


“যখন মানুষেরা অন্যায় দেখেও তা পরিবর্তন বা সংশোধন করবে না তখন যেকোনো মুহূর্তে আল্লাহর শাস্তি তাদের সবাইকে গ্রাস করবে।' (তিরমিজী) 


হযরত হুজায়ফা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«وَالذي نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أوْ لَيُوشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ»


“যার হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! তোমরা অবশ্যই কল্যাণের আদেশ করবে এবং মন্দ থেকে নিষেধ করবে, তা না হলে আল্লাহ অচিরেই তোমাদের সবার ওপর তাঁর গযব ও শাস্তি পাঠাবেন, তারপর তোমরা আল্লাহকে ডাকবে, কিন্তু তোমাদের ডাকে সাড়া দেওয়া হবে না বা তোমাদের দো‘আ কবুল করা হবে না।” (তিরমিজী) 


হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন আমি আল্লাহর নবীকে একথা বলতে শুনেছি যে, 

مَا مِنْ رَجُلٍ يَكُونُ في قَوْمٍ يَعْمَلُ فِيهِمْ بِالْمَعَاصِى يَقْدِرُونَ على أنْ يُغَيِّرُوا عَلَيْهِ فَلَا يُغَيِّرُواإلَّا أصَابَهُمُ اللهُ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِ أنْ يَمُوتُوا.


“কোনো সমাজের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি অবস্থান করে সেখানে অন্যায় পাপে লিপ্ত থাকে এবং সে সমাজের মানুষেরা তার সংশোধন-পরিবর্তন করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা না করে, তবে তাদের মৃত্যুর পূর্বেই আল্লাহর আযাব তাদেরকে গ্রাস করবে।” (আবু দাউদ) 


দাওয়াতে দ্বীনের কাজ না করলে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐক্য নষ্ট হবে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন- 


كَلَّا وَاللهِ لَتأمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمَنْكَرِ وَلَتَأْخُذُنَّ عَلى يَدِ الظَّالِمِ وَلَتَأْطُرُنَّهُ عَلى الْحَقِّ أطْرًا وَلَتَقْصُرُنَّهُ عَلى الْحَقِّ قَصْرًا أو لَيَضْرِبَنَّ اللهُ بِقُلُوبِ بَعضِكُمْ عَلى بَعْضٍ ثُمَّ لَيَلْعَنَنَّكُمْ كَمَا لَعَنِهُمْ


“মহান আল্লাহর কসম করে বলছি, তোমরা অবশ্যই সৎ কর্মের আদেশ করবে, অন্যায় থেকে নিষেধ করবে, অন্যায়কারী বা অত্যাচারীকে হাত ধরে বাধা দান করবে, তাকে সঠিক পথে ফিরে আসতে বাধ্য করবে। যদি তোমরা তা না কর তবে আল্লাহ তোমাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতা ও শত্রুতা সৃষ্টি করে দিবেন এবং তোমাদেরকে অভিশপ্ত করবেন যেমন ইসরাঈল সন্তানদেরকে অভিশপ্ত করেছিলেন।”[আবু দাউদ]


আদেশ-নিষেধের দায়িত্ব পালনে অবহেলাকারী নিজে পাপ না করেও অন্যের পাপের কারণে গুনাহের অংশীদার হবেন।


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إنَّهُ يُسْتَعْمَلُ عَلَيْكُمْ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ ألا نُقَاتِلُهُمْ قَالَ لا مَا صَلَّوا»


“অচিরেই তোমাদের ওপর অনেক শাসক-প্রশাসক আসবে যারা ন্যায় ও অন্যায় উভয় প্রকারের কাজ করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়কে ঘৃণা করবে সে অন্যায়ের অপরাধ থেকে মুক্ত হবে আর যে ব্যক্তি আপত্তি করবে সে (আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে) নিরাপত্তা পাবে। কিন্তু যে এ সকল অন্যায় কাজ মেনে নেবে বা তাদের অনুসরণ করবে (সে বাঁচতে পারবে না) সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? তিনি বললেন, না, যতক্ষণ তারা সালাত আদায় করবে।”[সহীহ মুসলিম]


অতএব দুনিয়ার শান্তি ও পরকালীন মুক্তির জন্য দাওয়াতে দ্বীনের কাজ গুরুত্ব সহকারে পালন করতে হবে।


আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দাওয়াতে দ্বীনের যথাযথ গুরুত্ব উপলব্দি ও তার প্রচার প্রসারে আত্মনিয়োগ করার তাওফিক দান করুক। আমীন। 


এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল 

লেখক ও ব্লগার 

Comments

পপুলার পোস্ট

দারসুল কুরআন| রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আহ্বানে করনীয় | সূরা মুদ্দাসসির (১-৭)

দারসুল কুরআনঃ ইসলামী আন্দোলন ও বাইয়াতের গুরুত্ব | এইচ.এম নুর আলম ফয়সাল|আলোর মশাল ব্লগ

দারসুল হাদীস : পাচটি বিষয়ের নির্দেশ