কুরআন সুন্নাহর আলোকে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সমাধানের উপায় ও আমাদের করণীয় || এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল

বিষয়ঃ কুরআন সুন্নাহর আলোকে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সমাধানের উপায় ও আমাদের করণীয়। 


কুরআন হাদীসে স্পষ্ট ও অস্পষ্টভাবে উল্লেখিত ইসলামের বিভিন্ন বিধান নিয়ে বিতর্ক ও মতবিরোধ সাহাবীদের যুগ থেকেই চলমান। এমনকি রাসূল (স) এর জীবদ্দশাতেও এমন ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। এর কারন হলো জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ কোন ব্যক্তির পক্ষেই ইলম বা জ্ঞানের সকল অধ্যায় ও স্তরের একচ্ছত্র অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। সে যা জানে তার বাহিরেও একই বিষয় সম্পর্কিত অথবা বিপরীত ইলম থাকতে পারে। রাসূল (স) এর জীবদ্দশায় কোন মতবিরোধ দেখা গেলে তা রাসূল (স) এর সামনে উপস্থাপন করা হলে উনি সমাধান করে দিতেন। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধে লিপ্ত হওয়া দু'জনই সঠিক হিসেবে বিবেচিত হতেন। এবং সমাধানের পর দু'জনই তা মেনে নিতেন।

কিন্তু গত কয়েক শতাব্দী থেকে অন্ধ ও গোড়ামী অনুসরণের কারনে মতবিরোধ বিবাদে রুপ নিয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীরাও নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিবাদে লিপ্ত। যার মধ্যে প্রধানত মাযহাব ও আহলে হাদীস কেন্দ্রীক জটিলতায় বর্তমান অধিকাংশ গ্রুপ একচ্ছত্রভাবে নিজেদের মতকে সঠিক এবং অন্যদের মতকে ভূল প্রমান করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। যা সম্পূর্ণ কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত।

আমরা কুরআন-সুন্নাহ ও সাহাবীদের জীবনি থেকে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। 

★ যদি কোন বিষয়ে কখনো বিতর্ক বা মতবিরোধ তৈরি হয় তাহলে তা আল্লাহর কিতাব ও রাসূল (স) এর সুন্নাহ দিয়ে জাস্টিফাই করতে হবে। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন- 
وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِن شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ 
"তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর, তার ফয়সালা আল্লাহর কাছে সোপর্দ।" (সূরা আশ শূরা-১০) 

কেননা আল্লাহর কিতাবে সকল কিছুর বিবরণ পেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- 
إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللّهُ وَلاَ تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًا
"নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না।" (সূরা নিসা-১০৫) 

مَّا فَرَّطْنَا فِي الكِتَابِ مِن شَيْءٍ 
"আমি কোন বিষয়ই আল কিতাবে লিখতে বাদ রাখিনি।" (সূরা আনআম-৩৮) 

আকিদা ও ইবাদতগত স্পষ্ট- অস্পষ্ট যেকোন বিষয়ই হোক না কেন, মুমিনের বিশ্বাস থাকতে হবে যে তা ওহীর মাধ্যমে সমাধান দেওয়া আছে। কিতাবুল্লাহতে সরাসরি না থাকলেও, রাসূল (স) এর সুন্নাহতে তা রয়েছে। কেননা কিতাব ও সুন্নাহ উভয়ই ওহী। আল্লাহ বলেন- 
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى-

"সে (মুহাম্মদ স.) নিজের মন গড়া কথা বলেনা, যা বলে তা প্রেরিত ওহী ছাড়া আর কিছু নয়।" ( সূরা আন নাজম, ৩-৪) 

আল্লাহ আরো বলেন- 
فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً

"যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়, তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর-যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম।" (নিসা-৫৯) 

মতবিরোধপূর্ণ বিষয় সমূহের সমাধানের জন্য শরীয়তের মূল উৎস তথা কুরআন ও সুন্নাহর অনুগামী না হলে বিবেদ ও বিভাজন বাড়তেই থাকবে। যার দরুন ইসলাম অনুসারীরাই ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- 
فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّىَ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُواْ فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا

"অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।" (সূরা নিসা-৬৫) 

সকল মতবিরোধের সমাধান রাসূল (স) এর দিকে সোপর্দ করতে হবে এজন্যই যে, কারন আল্লাহর পক্ষ থেকে সকল কিছুর সুস্পষ্ট দলীল তার নিকটই অবতীর্ণ করা হয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন- 
 بِالۡبَيِّنٰتِ وَالزُّبُرِ‌ؕ وَاَنۡزَلۡنَاۤ اِلَيۡكَ الذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُوۡنَ‏

"আগের রসূলদেরকেও আমি উজ্জ্বল নিদর্শন ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম এবং এখন এ বাণী তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যেতে থাকো। যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে। এবং যাতে লোকেরা (নিজেরাও) চিন্তা-ভাবনা করে।" (সূরা নাহল-৪৪) 

মতবিরোধ জ্ঞানকে সম্প্রসারিত করে, অধ্যয়ন ও গবেষনার নতুন দ্বার উন্মোচন করে। কিন্তু মতবিরোধ যখন নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে হয় তখন সেখানে দ্বন্দ-কলহ শুরু হয়ে যায়।

 ذٰلِكَ بِاَنَّ اللّٰهَ نَزَّلَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّؕ وَاِنَّ الَّذِيۡنَ اخۡتَلَفُوۡا فِىۡ الۡكِتٰبِ لَفِىۡ شِقَاقِۢ بَعِيۡدٍ‏

"এসব কিছুই ঘটার কারণ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ‌ তো যথার্থ সত্য অনুযায়ী কিতাব নাযিল করেছিলেন কিন্তু যারা কিতাবে মতবিরোধ উদ্ভাবন করেছে তারা নিজেদের বিরোধের ক্ষেত্রে সত্য থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে।" (বাকারা-১৭৬) 

উপরেও উল্লেখ করেছি মুমিন বান্দাহদের একথা অবশ্যই আস্থার সাথে স্বীকার করতে হবে যে, আকীদাহ ও ইবাদাতের চুড়ান্ত সমাধান রাসূল (স) এর জীবনিতেই রয়েছে। এ নিয়ে নতুন মতভেদের প্রয়োজন নেই। তবে পৃথিবীর রুপ যেহেতু নিয়মিতই পরিবর্তন হবে সেহেতু যুদ্ধ, রাস্ট্র, সামাজিক ন্যায়নীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে মৌলিকত্বের আলোকে গবেষনা চলতেই থাকবে। কিন্তু আকীদার কোনরুপ চেইঞ্জ আসবে না, এমনকি উপকরণে চেইঞ্জ আসলেও ইবাদতের মূল কাঠামোতে কোনরুপ চেইঞ্জ আসব না। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন- 

 الۡيَوۡمَ اَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِيۡنَكُمۡ وَاَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِىۡ وَرَضِيۡتُ لَكُمُ الۡاِسۡلَامَ دِيۡنًا‌ؕ
"আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি ।" (সূরা মায়েদা- ৩) 

এখন প্রশ্ন হলো, কুরআনের এ আয়াত নাজিলের পরেও মতবিরোধ বন্ধ না হওয়ার কারন কি? আকীদা নিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারীদের মধ্যে মতবিরোধ না থাকলেও মৌলিক ইবাদাতের ছোটখাটো বিভিন্ন বিষয়ে মতভেদ এখনো চলমান। অনেকাংশে এখন তা বিবাদে পরিনত হয়েছে। এর কারন কি!! কারন একটাই, বিধান থেকে সমাধান না খোঁজা, অথবা কেউ সমাধান দিলেও নিজের মতকে উপরে রাখার মানসিকতা ইত্যাদি।

অথচ রাসূল (স) বলেছেন, "আমি তোমাদের মাঝে দু'টি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। তাহলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ।" 

............ চলবে।

এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল

Comments

পপুলার পোস্ট

দারসুল কুরআন| রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আহ্বানে করনীয় | সূরা মুদ্দাসসির (১-৭)

দারসুল কুরআনঃ ইসলামী আন্দোলন ও বাইয়াতের গুরুত্ব | এইচ.এম নুর আলম ফয়সাল|আলোর মশাল ব্লগ

দারসুল হাদীস : পাচটি বিষয়ের নির্দেশ