কুরবানী: পর্ব-০২ || এইচ. এম নূর আলম ফয়সাল
কুরবানী: পর্ব-০২
[পশু যবাইয়ের সময়, নিয়ম, গোশত বন্টন ও গোশত জমা রাখার বিধান, কুরবানীর সাথে আকীকা]
[ ] যবাইয়ের সময়:
কুরবানির পশু যবাইয়ের শর্ত হলো, ১০ ই জিলহজ তথা ঈদের দিন সূর্য উদয়ের পর ঈদের সালাত আদায় করে উপযুক্ত স্থানে পশু যবাই করবে। ঈদের সালাতের পূর্বে কুরবানির নিয়তে পশু যবাই বৈধ নয়। একইসাথে পরবর্তী তিনদিন (আইয়ামে তাশরীক) যেকোন সময়ে কুরবানির নিয়তে পশু যবাই করা যাবে। যারা শুধুমাত্র একটি পশু কুরবানি করবে তাদের জন্য ঈদের দিন যবাই করা উত্তম। তবে কেউ যদি ১১,১২ বা ১৩ তারিখেও যবাই করে তার কুরবানি শুদ্ধ হবে।
রাসূল (স) বলেন, ঈদের (আযহা) দিন আমাদের প্রথম কাজ হলো নামাজ পড়া, তারপর বাড়িতে ফিরে যাওয়া এবং কুরবানি করা। যে ব্যক্তি এরুপ করবে সে আমাদের সুন্নত মেনে চলবে। আর যে ব্যক্তি এর আগে যবাই করবে, সে তার পরিবারের জন্য কিছু গোশতের ব্যবস্থা করতে পারবে বটে, তবে তার কুরবানি হবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ)
[ ] যবাইয়ের নিয়ম:
★ যবাই করতে সক্ষম এবং যবাইয়ের কাজে পারদর্শী এমন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের কুরবানির পশু নিজেই যবাই করবে। আর নিজের পশু নিজে কুরবানি করা সুন্নত। যবাইয়ের সময় বলবে بسم الله الله أكبر
তবে কেউ যদি সাহস করতে না পারে তাহলে দক্ষ কাউকে দিয়ে পশু যবাই করিয়ে নিবে। এবং কুরবানি দাতা পশু যবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করবে। রাসূল (স) ফাতেমা রা. কে বলেছিলেন, হে ফাতেমা, দাড়াও এবং তোমার কুরবানি দেখ, কেননা ওর রক্তের প্রথম ফোঁটা পড়া মাত্রই তোমার অতীতের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। তুমি বলো -
قُلۡ اِنَّ صَلَاتِىۡ وَنُسُكِىۡ وَمَحۡيَاىَ وَمَمَاتِىۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَۙ
لَا شَرِيۡكَ لَهٗۚ وَبِذٰلِكَ اُمِرۡتُ وَاَنَا اَوَّلُ الۡمُسۡلِمِيۡنَ
'আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন-মৃত্যু সবকিছু বিশ্বজাহানের একমাত্র প্রতিপালক আল্লাহর জন্য'।
'যার কোন শরীক নেই। এরই নির্দেশ আমাকে দেয়া হয়েছে এবং সবার আগে আমিই আনুগত্যের শির নতকারী'। (আনয়াম- ১৬২-৬৩)
অন্যকোন ব্যক্তির দ্বারা যদি কুরবানির পশু যবাই করা হয় সেক্ষেত্রে কুরবানি দাতার নাম উল্লেখ করে যবেহ করা উত্তম। এভাবে উচ্চারণ করবে -
بسم الله الله أكبر اللهم هٰذَا عَن فُلَانُ۔
অর্থাৎ আল্লাহর নামে, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, হে আল্লাহ এটা অমুকের পক্ষ থেকে (এখানে দাতার নাম উচ্চারণ করবে)
একটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। দাতার পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কুরবানি হবে, দাতার নামে নয়। যেমন রাসূল (স) একটা ভেড়া যবাই করে বললেন, 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, হে আল্লাহ এই কুরবানি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার উম্মতের যারা কুরবানি করেনা তাদের পক্ষ থেকে'। (তিরমিজি)
কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃভাবে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার না বলে তাহলে যবেহ শুদ্ধ না হওয়ার ব্যাপারে অনেক ফিকাহবিদ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ভুলবশত কেউ উচ্চারণ না করলে যবেহ শুদ্ধ হয়ে যাবে।
★ পশু যবাইয়ের সময়ে গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করা হবে। অর্থাৎ গরু ও ছাগলকে তার বাম পাশের ওপর ভর দিয়ে শুইয়ে দিবে এবং ঘাড়ের ওপর ডান পা দিয়ে চেপে ধরবে এবং চিৎ করে মাথা চেপে ধরে যবাই করবে।
ধারালো চুরি দিয়ে কন্ঠনালী, খাদ্যনালী এবং উভয় পাশের দু'টি রগ অর্থাৎ চারটি রগ কাটতে হবে। তবে তিনটি রগ কাটা হলেও যবেহ শুদ্ধ হয়ে যাবে। কোনভাবেই তাড়াতাড়ি রক্তক্ষরণের জন্য এলেমেলোভাবে চুরি চালিয়ে পশুকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
কোন কারনে যদি চুরি চালানোর সময় অপর কেউ সহযোগিতা করে তবে তাকেও 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' উচ্চারণ করা উচিৎ।
কুরবানির পশুর কাজ সম্পাদনের জন্য যদি কোন কসাই বা ব্যক্তিকে শ্রমিক হিসেবে নেওয়া হয় তাহলে তাকে আলাদাভাবে পারিশ্রমিক দিতে হবে। পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির পশুর মাংস দেওয়া বৈধ নয়।
[ ] কুরবানির গোশত বন্টন ও জমা রেখে খাওয়া:
কুরবানির গোশত কুরবানি দাতা নিজে খাবে, আত্মীস্বজনদের উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করবে এবং ফকির-মিসকিনদের সাদকা করবে, এটাই সুন্নাত। কেননা রাসূল (স) বলেছেন, তোমরা কুরবানির গোশত খাও, খাওয়াও এ সঞ্চয় করে রাখো।
সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রাসূল (স) বলেন,
فَقَالَ اِنَّمَا نَهَيتُکُم مِن اَجلِ الدَّافَّةِ الَّتِي دَفَّت ۔ فَکُلُوا وَدَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا۔
'আমিতো তোমাদের এজন্য নিষেধ করেছিলাম যে, বন থেকে কিছু লোক এসেছে (অর্থাৎ তারা যেন এ থেকে সাহায্যে প্রাপ্ত হয়) অতএব এখন তোমরা খাও, সাদকা করো এবং কিছু জমা রাখো'।
অতএব নিয়তের পরিশুদ্ধতা রেখে ফকীর-মিসকিনকে সাদকা ও অসচ্ছল আত্মীয় স্বজনদের খাওয়ানোর পরেও যদি কুরবানী দাতা অনেক সময় ধরে জমা রেখে কুরবানির মাংশ ভক্ষন করে তাতে কোন অসুবিধা নেই। তবে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে গোশত খাওয়ার নাম কিন্তু কুরবান নয়। আল্লাহর বিধান পালন ও তার সন্তুষ্টি হাসিলই হলো কুরবান।
পশু ক্রয়ের সময় অবশ্যই সুন্দর, মোটাতাজা দেখেই কিনবো। কেননা এথেকে নিজে ও আত্মীয় স্বজন এবং দরিদ্ররা গোশত ভক্ষন করবে। কিন্তু কোনভাবেই গোশত খাওয়ার নিয়তে পশু ক্রয় করা যাবে না। অর্থাৎ মোটাতাজা পশু এজন্যই ক্রয় করবো যেন বেশীদিন যাবৎ গোশত খেতে পারি, এ নিয়ত করা যাবে না। অন্যথায় কুরবানি শুদ্ধ হবে না।
কেননা কুরবানির উদ্দেশ্যই হলো অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
لَنۡ يَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنۡ يَّنَالُهُ التَّقۡوٰى مِنۡكُمۡؕ -
'তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হজ- ৩৭)
আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে যে, কুরবানির গোশত সমান তিনভাগে বিভক্ত করে ১ ভাগ নিজেদের জন্য, ১ ভাগ আত্বীয় স্বজনের জন্য, ১ ভাগ গরীব মিসকিনদের জন্য। এ প্রচলনের পক্ষে অনেক আলেমেরও মতামত রয়েছে। এবং এটি নাজায়েজও নয়। তবে হুবহু তিনভাগ না করলেও কোন সমস্যা নেই। তবে অবশ্যই যথাসম্ভব মিসকিনদের সাদকা করতে হবে কেননা এ ব্যাপারে রাসূল (স) এর স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। সাদকার পর বাকী গোশত নিজ পরিবার ও আত্মীয় স্বজন নিয়ে কুরবানি দাতা সন্তুষ্টচিত্তে ভক্ষন করবে।
কুরবানির পশুর কোন কোন অঙ্গ খাওয়া যাবে, আর কোন কোন অঙ্গ খাওয়া যাবে না সে সম্পর্কে আলেমদের মতামত হলো, যে কোন হালাল পশুর যে ৭টি অঙ্গ খাওয়া হারাম সেগুলো হলো: প্রবাহিত রক্ত, নর প্রাণীর পুং লিঙ্গ, অন্ডকোষ, মাদী প্রাণীর স্ত্রী লিঙ্গ, মাংসগ্রন্থি, মুত্রথলি, পিত্ত। এছাড়া বাকি সবই খাওয়া জায়েজ।
★ কুরবানির পশুর চামড়া কুরবানি দাতা সাদকা করতে পারবে, নিজে খেতে পারবে, এবং ব্যবহার করতে পারবে। যদি চামড়া বিক্রি করে দেওয়া হয় তাহলে সে টাকা কুরবানি দাতা আর খরচ করতে পারবে না। সম্পূর্ণ টাকা সাদকা করে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে এতিমখানায় গোরাবা ফান্ডে সাদকা করা বেশী ভালো। অথবা সমাজের মধ্যে যারা সাদকা খাওয়ার উপযোগী তাদের মধ্যে বন্টন করে দিতে হবে।
কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় কোন কাজ করা যাবে না। কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। মসজিদ, মাদ্রসা নির্মাণে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন প্রদানে বা অন্য কোন জনকল্যাণ মূলক কাজেও এ টাকা ব্যবহার করা যাবে না।
[ ] কুরবানীর সাথে আকীকা:
কুরবানির সাথে একই পশুতে বা আলাদা পশুতে কুরবানির সাথে আকীকা দেওয়া যাবে কিনা এব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তবে মতভেদ যাই থাকুক সবার আগে একজন মুসলিম হিসেবে আকীকা সম্পর্কে একেবারে স্বচ্ছ ধারনা রাখা উচিৎ। তাহলে এ ব্যাপারটি সহজেই বোধগম্য হবে।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের অনুসারী আলেমদের মতে, আকিকার দিনের সাথে কুরবানির দিন একত্রিত হলে এ দু'টোর যেকোন একটি সম্পাদন করে উভয়টি সম্পাদনের সৌভাগ্য লাভ করা যায়। (ফিকহুস সুন্নাহ)
আকীকা একটি স্বতন্ত্র ইবাদাত। সন্তান জন্মগ্রহণের সপ্তম দিনে তা সম্পন্ন করতে হয়। অনেকের মতে ৭ম দিনে না পারলে, ১৪ তম দিনে, সেদিনও না পারলে ২১ তম দিনে, আর্থিক সমস্যার কারনে সেদিনও না পারলে পরবর্তী যেকোন দিন করতে পারবে। তবে সুন্নাহ হচ্ছে সপ্তম দিনে করা।
আবার অনেকে কুরবানির গরুতে অতিরিক্ত এক শরীকে আকীকা করে থাকে তাও সুন্নাহ সম্মত নয়। কিছু আলেম এটাকে বৈধ বা জায়েজ বলেছেন কিন্তু সুন্নতের অনুসরণ না হওয়ারও ঘোষনা দিয়েছেন। আকীকার ক্ষেত্রে ছাগল বা দুম্বা দিয়ে তা সম্পন্ন করতে হয়, এটাই রাসূল (স) এর সুন্নাহ।
অতএব যদি কোন সন্তানের জন্মের ৭ম দিবস ঈদের দিন হয় অথবা আইয়ামে তাশরিকে ৭ম দিবস পূর্ণ হয় এবং সন্তানের পিতা আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় তাহলে তার উচিৎ গরু/মহিষ/উট দ্বারা তার কুরবানি সম্পম্ন করবে এবং ছাগল/ দুম্বা দ্বারা (ছেলে হলে ২টি, মেয়ে হলে ১টি) আলাদাভাবে আকীকা সম্পাদন করবে।
যদি সন্তানের পিতা অসচ্ছল হয় এবং ছাগল/ভেড়া/দুম্বা দ্বারা কুরবানি সম্পাদন করেন তাহলে অবশ্যই তাকে আকীকার জন্য আলাদা ছাগল বা দুম্বা ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা গরু/উট/ মহিষ ছাড়া অন্য পশুতে শরীক নেওয়া যায় না। (আকীকার ক্ষেত্রে গরুতে শরীক নিলেও তা সুন্নাহ সম্মত হবে না)। অসচ্ছলতার কারনে ৭ম দিনে কষ্টসাধ্য হলে ১৪ তম অথবা ২১ তম দিনে সম্পাদন করলেও পারবে। আর যদি আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে কুরবানি ওয়াজিব না হয় তাহলে শুধুমাত্র আকীকার কাজ সম্পাদন করে নিবেন।
আকীকার গোশত সন্তানের পিতামাতা, ভাইবোন আত্মীয় স্বজন সবাই খেতে পারবে। এক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ নেই। তবে মিসকিনরা যেন বাদ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা উচিৎ।
কুরবানী: পর্ব-০১
https://alor-moshal.blogspot.com/2020/07/blog-post_25.html
এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল
নোয়াখালী
Comments
Post a Comment