কুরবানী: পর্ব-০১ || এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল

কুরবানী: পর্ব-০১
[উৎপত্তি, বিধান, লক্ষ্য উদ্দেশ্য, ফযীলত, পশুর বিবরণ, শরীক] 


[ ] কুরাবানীর উৎপত্তিঃ 
★আমরা জানি যে পৃথিবীর প্রথম কুরবানি হলো হাবিল ও কাবিলের কুরবানি। আদম (আ) এর সন্তান হাবিল কাবিল ছিলো দুই ভাই। কাবিল বড় হাবিল ছোট। 

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, আদম (আ) সন্তানদের মধ্যে এক গর্ভের পুত্র সন্তানের সাথে অন্য গর্ভের কন্যা সন্তানের বিবাহ দিতেন ( সে সময় মা হাওয়ার প্রত্যেক গর্ভপাতে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে জন্ম নিতো) । সে মতে হাবিল কাবিলের যমজ বোনকে বিবাহের জন্য মনস্থির করে। কিন্তু কাবিল এটা মানতে পারেনি। তার বোন ছিলো সুন্দরী ও রুপবতী। 

তাই কাবিল নিজেই বোনকে বিয়ে করতে চাইলো এবং আদম (আ) এর আদেশও অমান্য করলো। তারপর আদম (আ) তাদের উভয়কে কুরবানি করতে বলে তিনি হজ্জের জন্য মক্কায় চলে যান। 

আদম (আ) চলে গেলে তারা কুরবানি করে। তখন নিয়ম ছিল, কোরবানির বস্তু একটি খোলা প্রান্তরে রেখে আসতে হবে। আকাশ থেকে আগুন এসে যদি তা জ্বালিয়ে দেয় বুঝতে হবে কোরবানি কবুল হয়েছে। আর যদি কোরবানির সামগ্রী অক্ষত থাকে, তার মানে এ কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়নি।

পেশায় হাবিল ছিলেন রাখাল। তিনি তার দুম্বার পাল থেকে সবচেয়ে সুঠাম দুম্বাটি রেখে এলেন কোরবানির জন্য। কাবিল ছিলো কৃষক। সে হাবিলের দুম্বার পাশেই কিছু নিম্মমানের শস্য রেখে গেলেন। পেশায় কৃষক হওয়ায় এই ছিল তার সম্বল। পরদিন সকালে দেখা গেল হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছে। কাবিলের শস্য অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। এই দেখে কাবিল রেগে যান। তিনি তার ভাইকে বলেন, ‘লাআক তুলান্নাকা’। ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব।’ উত্তরে হাবিল বললো আল্লাহ তায়ালা কেবল মুত্তাকিদের কুরবানিই কবুল করে। 

অত:পর কিছুদিন পর কাবিল হিংসার বশে হাবিলকে হত্যা করে। 

হাবিল-কাবিলের কুরবানির বর্ণনা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন- 

وَاتۡلُ عَلَيۡهِمۡ نَبَاَ ابۡنَىۡ اٰدَمَ بِالۡحَقِّ‌ۘ اِذۡ قَرَّبَا قُرۡبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنۡ اَحَدِهِمَا وَلَمۡ يُتَقَبَّلۡ مِنَ الۡاٰخَرِؕ قَالَ لَاَقۡتُلَنَّكَ‌ؕ قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللّٰهُ مِنَ الۡمُتَّقِيۡنَ

"আর তাদেরকে আদমের দু’ছেলের সঠিক কাহিনীও শুনিয়ে দাও। তারা দু’জন কুরবানী করলে তাদের একজনের কুরবানী কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না। সে বললো, “আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। সে জবাব দিল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকে।” (মায়েদা -২৭) 

★বর্তমান কালের ঈদুল আজহার কুরবানি হযরত ইবরাহীম (আ) এর কুরবানির অনুসরণে হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ) নিজের জন্য পরিক্ষা স্বরুপ নিজ সন্তানকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবান করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করলে আল্লাহ তায়ালা তার হেকমত প্রকাশ করে দেন। অত:পর পশু (ভেড়া) কুরবানি করেন। 

এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা সূরা সাফফাতে বলেন - 

১০২) সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছুলো তখন (একদিন ইবরাহীম তাকে বললো, “ হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে আমি যাবেহ করছি,  এখন তুমি বল তুমি কি মনে কর?”  সে বললো, “ হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে  তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন৷”  

১০৩) শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিল এবং ইবরাহীম পুত্রকে (যবেহের জান্য) উপুড় করে শুইয়ে দিল৷ 

১০৪) এবং আমি আওয়াজ দিলাম, “ হে ইবরাহীম"

১০৫) তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো৷ আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি৷

১০৬) নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা৷”

১০৭) একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। 

[ ] কুরবানির বিধানঃ 
জিলহজ্জ মাস ও আইয়ামে তাশরিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু (উট, গরু, ভেড়া, ছাগল, মেষ-দুম্বা) যবাই করা হয় তাকে কুরবানি বলে।

কুরবানির বিধান সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 
اِنَّاۤ اَعۡطَيۡنٰكَ الۡكَوۡثَرَ-  فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانۡحَرۡؕ‏- اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الۡاَبۡتَرُ
(হে নবী!) আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি। কাজেই তুমি নিজের রবেরই জন্য নামায পড়ো ও কুরবানী করো। নিশ্চয়ই তোমার দুশমনই শিকড় কাটা।

প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির পক্ষে কুরবানি ওয়াজিব। কোন কোন ফকিহ বলেছেন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। 

সামগ্রিকভাবে কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি থেকে বিরত থাকা গর্হিত কাজ। তবে ইমাম আবু হানিফার মতে, মুসাফির নয় এমন নিসাবের অধিকারী স্বচ্ছল ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব। কেননা রাসূল (স) বলেছেন, 'যার সামর্থ্য আছে, কিন্তু কুরবানি করলো না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে'। 

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূল (স) এর কাছে দ্বীন সম্পর্কে জানতে এসেছিলো। লোকটি ফিরে যাওয়ার সময় রাসূল (স) তাকে ডাকলেন এবং বললেন - 
اُمِرتُ بِيَومِ الاَضحَی ۔جَعَلَ اللهُ عِيدًا لِهٰذِهِ الاُمَّةِ۔ 
'আমাকে ইয়াওমুল আজহার আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানি করার আদেশ করা হয়েছে)। এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন'। (মুসনাদে আহমদ) 

[ ] কুরবানির লক্ষ্য উদ্দেশ্যঃ 
কুরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। লোকদেখানো কিংবা সম্পদের বাহাদুরি দেখিয়ে কুরবানি করলে তা জায়েজ হবে না বরং গুনাহ হবে। পারতপক্ষে তা শিরকের পর্যায়ে পৌছাবে। 

আল্লাহ তায়ালা বলেন - 
 لَنۡ يَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنۡ يَّنَالُهُ التَّقۡوٰى مِنۡكُمۡ‌ؕ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُوۡا اللّٰهَ عَلٰى مَا هَدٰٮكُمۡ‌ؕ وَبَشِّرِ الۡمُحۡسِنِيۡنَ‏
'তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি তাদেরকে (এসব পশুকে) তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। তিনি তোমাদের হেদায়েত করেছেন। আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও'। (সূরা হজ- ৩৭) 

قُلۡ اِنَّ صَلَاتِىۡ وَنُسُكِىۡ وَمَحۡيَاىَ وَمَمَاتِىۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَۙ
'আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন-মৃত্যু সবকিছু বিশ্বজাহানের একমাত্র প্রতিপালক আল্লাহর জন্য'। (আনয়াম- ১৬২)

অতএব কুরবানি করার পূর্বে লক্ষ্য- উদ্দেশ্য তথা নিয়ত পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে। অন্যথায় যত বড় ও দামী পশুই যবেহ করা হোক না কেন তা কোন কাজে আসবে না। 

[ ] কুরবানির ফযীলতঃ 
ইমাম তিরমিজি হযরত আয়েশা (রা) এর সূত্রে বর্ণনা করেন। রাসূল (স) বলেছেন, আদম সন্তান কুরবানির দিনে কুরবানির জন্তু যবাই করার চাইতে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় আর কোন কাজ করে না। কুরবানির জন্তু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও নখরসহ আসবে, আর কুরিবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর নিকটবর্তী স্থানে পতিত হয়। সুতরাং তোমরা কুরবানি নিয়ে আনন্দ করো। 

[ ] কুরবানির শর্তসমূহ / কুরবানির পশুর মাসায়েলঃ 

★উট, গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মেষ-দুম্বা ব্যতিত অন্যকোন পশু দ্বারা কুরবানি বৈধ হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- 
وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَكًا لِّيَذۡكُرُوۡا اسۡمَ اللّٰهِ عَلٰى مَا رَزَقَهُمۡ مِّنۡۢ بَهِيۡمَةِ الۡاَنۡعَامِ‌ؕ -
'প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে তাদেরকে জীবন উপকরণ স্বরুপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারন করে'। (সূরা হজ -৩৪) 

★ছয় মাসের মেষ-দুম্বা, এক বছরের ছাগল, দুই বছরের গরু-মহিষ ও পাঁচ বছরের উট কুরবানি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত, সেটা নর হোক কিংবা মাদি। খাসি দ্বারাও কুরবানি জায়েজ।

★রোগাগ্রস্ত, একচোখ কানা, দর্শনীয়ভাবে খোড়া, মস্তিষ্ক বিকৃত, অন্ধ-খোড়া-কান কাটা-লেজ কাটা এতই দূর্বল যে কুরবানির যায়গায় হেটে যেতে অক্ষম, হিজড়া ও দন্তহীন, অসুস্থ ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানি করা নাজায়েজ। 

[ ] কুরবানির শরীকঃ 

★ উট, গরু-মহিষ দ্বারা কুরবানি করলে তাতে একাধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ। সবার নিয়ত যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হয়ে থাকে তাহলে একটা উট বা গরু-মহিষে সাতজন পর্যন্ত শরীক হতে পারবেন৷ তবে অন্যান্য পশুতে একের অধিক শরীক বৈধ নয়। রাসূল (স) বলেন- 

اَنَّ رَسُولُ اللهِ ﷺ قَالَ البَقَرَةُ عَن سَبعَةٍ وَالجَزُورُ عَن سَبعةٍ ۔
'নবী করীম (স) বলেছেন, গাভি ও উট সাত ব্যক্তির পক্ষ হতে কুরবানি করা যাবে'। (আবু দাউদ) 

★ এক পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ভেড়া বা ছাগল দিয়ে যদি কুরবানি করে তাহলে সেটি তার ও পরিবারের জন্য যথেষ্ট হবে। 

★ মৃত মানুষের পক্ষ থেকে কুরবানি করা বৈধ। তবে কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করে না যায় তাহলে সেটা বাধ্যতামূলক নয়। অন্যথায় পরিবারের জীবিত ব্যক্তিরা কুরবানী করলেই হবে। 

আলী (রা) বলেন, রাসূল (স) আমাকে অসিয়ত করে গেছেন যে, আমি যেন তার পক্ষ থেকে কুরবানি করি। (আবু দাউদ) 

............... চলবে।

এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল 
লেখক ও ব্লগার 

Comments

পপুলার পোস্ট

দারসুল কুরআনঃ ইসলামী আন্দোলন ও বাইয়াতের গুরুত্ব | এইচ.এম নুর আলম ফয়সাল|আলোর মশাল ব্লগ

দারসুল কুরআন| রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আহ্বানে করনীয় | সূরা মুদ্দাসসির (১-৭)

দারসুল হাদীস : পাচটি বিষয়ের নির্দেশ