আকীদা (ঈমান) : পর্ব- ০২ || এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল
আকীদা (ঈমান) : পর্ব- ০২
আমরা প্রথম পর্বের আলোচনা থেকে মোটামুটি বুঝতে পেরেছি যে, আমল বা ইবাদাত হিসেবে যা কিছুই করি না কেন তা কবুল ও ফলপ্রসূ হওয়ার শর্ত হলো আকীদার পরিশুদ্ধতা। অতএব আকীদা সম্পর্কে জানা ও বুঝার অপরিসীম গুরুত্ব এর মাধ্যমেই উপলব্দি করা যায়।
আকীদা সম্পর্কে অধ্যয়ন, আলোচনা ও নসীহতের মাধ্যমে ঈমানের সঠিক কাঠামো ও তার স্বরুপ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। ঈমান বিনষ্টকারী কারন সম্পর্কে সচেতন হওয়া যায়, ভ্রান্ত ও বাতিল আকীদা বা বিশ্বাস সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করা যায়।
সুতরাং ইবাদাত ও আমলকে আল্লাহর দরবারে কবুল করতে হলে অবশ্যই শিরক, কুফরী মুক্ত সাচ্ছা ঈমান বা আকীদার অনুসারী হতে হবে।
★দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম জীবন লাভের একমাত্র নিয়ামক হলো ঈমান বা আকীদার সহীহ বিশ্বাস। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَلَوۡ اَنَّ اَهۡلَ الۡقُرٰٓى اٰمَنُوۡا وَاتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَيۡهِمۡ بَرَكٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالۡاَرۡضِ وَلٰكِنۡ كَذَّبُوۡا فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِمَا كَانُوۡا يَكۡسِبُوۡنَ
যদি জনপদের লোকেরা ঈমান আনতো এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করতো, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর রবকতসমূহের দুয়ার খুলে দিতাম। কিন্তু তারা তো প্রত্যাখ্যান করেছে। কাজেই আমি তাদের কর্ম অনুযায়ী প্রতিদান দান করলাম (আরাফ-৯৬)
وَمَنۡ اَرَادَ الۡاٰخِرَةَ وَسَعٰى لَهَا سَعۡيَهَا وَهُوَ مُؤۡمِنٌ فَاُولٰۤٮِٕكَ كَانَ سَعۡيُهُمۡ مَّشۡكُوۡرًا
আর যে ব্যক্তি আখেরাতের প্রত্যাশী হয় এবং সেজন্য প্রচেষ্টা চালায়, যেমন সেজন্য প্রচেষ্টা চালানো উচিত এবং সে হয় মুমিন, এক্ষেত্রে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রচেষ্টার যথোচিত মর্যাদা দেয়া হবে। (বনী ঈসরাইল -১৯)
مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَكَرٍ اَوۡ اُنۡثٰى وَهُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡيِيَنَّهٗ حَيٰوةً طَيِّبَةًۚ وَّلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ اَجۡرَهُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا كَانُوۡا يَعۡمَلُوۡنَ
পুরুষ বা নারী যে-ই সৎকাজ করবে, সে যদি মু’মিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবন দান করবো এবং (আখেরাতে) তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে। (নাহল- ৯৭)
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা (রা) এর বর্ণনায় রাসূল (স) বলেছেন-
اُمِرتُ اَن اُقَاتِلُ النَّاسَ حَتّٰی يَقُولُ لاَ اله اِلا اللّٰهُ فَمَن تَبِعَ قال لاَ اله اِلا اللّٰهُ فَقَد عَصَمَ مِنِّی نَفسَه وَمَا لَه اِلّا بِحَقِّهِ وَحِسَابُه عَلَی اللّٰه۔
"যতক্ষণ মানুষ এ সাক্ষ্য না দিবে যে, 'আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই' , ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদিষ্ট হয়েছি। কাজেই যে ব্যক্তি স্বীকার করে নেবে যে, 'আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই', সে আমার থেকে তার জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করে নিল। তবে শরীয়াহ সম্মত কোন কারন ঘটলে তা ভিন্ন কথা। আর তার (কৃতকর্মের) হিসাব-নিকাশ আল্লাহর কাছে"। (শুয়াবুল ঈমান)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় পরকালে কর্মের আলোকে প্রতিদান দেওয়া হবে কিন্তু কর্ম যেমনই হোক না কেন তার স্বীকৃতির জন্য প্রধান শর্ত হলো ঈমানের পরিশুদ্ধতা। যেটাকে আমরা বলতেছি আকীদা।
★ঈমান বা আকীদার সহীহ বিশ্বাস ছাড়া সকল (আমল) কর্মই অর্থহীন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন-
اِنَّ اللّٰهَ لَا يَغۡفِرُ اَنۡ يُّشۡرَكَ بِهٖ وَيَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِكَ لِمَنۡ يَّشَآءُۚ وَمَنۡ يُّشۡرِكۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤى اِثۡمًا عَظِيۡمًا
আল্লাহ অবশ্যই শিরককে মাফ করেন না।এছাড়া অন্যান্য যত গোনাহ হোক না কেন, তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেছে সেতো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গোনাহের কাজ করেছে। (নিসা-৪৮)
وَلَقَدۡ اُوۡحِىَ اِلَيۡكَ وَاِلَى الَّذِيۡنَ مِنۡ قَبۡلِكَۚ لَٮِٕنۡ اَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِيۡنَ
(তোমার উচিত তাদের একথা স্পষ্ট বলে দেয়া, কারণ) তোমার কাছে এবং ইতিপূর্বেকার সমস্ত নবীর কাছে এ অহী পাঠানো হয়েছে যে, যদি তুমি শির্কে লিপ্ত হও তাহলে তোমার আমল ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। (যুমার-৬৫)
وَمَن يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
আর যে ব্যক্তি ঈমানের পথে চলতে অস্বীকার করবে, তার জীবনের সকল সৎ কার্যক্রম নষ্ট হয়ে যাবে এবং আখেরাতে সে হবে নিঃস্ব ও দেউলিয়া। (মায়েদা-৫)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইবাদাত বা কর্ম সকল কিছুরই মূল হলো ঈমান বা আকীদা। এটা যদি ঠিক না থাকে তাহলে আমলেরও পরিশুদ্ধতা থাকবে না। কারন আমলের ভিত্তি হলো আকীদা। আকীদায় ত্রুটি থাকলে আমলের মধ্যে শিরক ও বেদায়াতের অনুপ্রবেশ অবশ্যই ঘটবে।
এখানে ইবাদাত বা আমলকে কোনভাবেই খাটো করা হচ্ছে না। শুধুমাত্র বুঝাতে চাচ্ছি, আমরা যে আমল করবো তার ভিত্তি কি। আমরা জানি রাসূল (স) বলেছেন- ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের ওপর: কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত।
এ হাদীস থেকেও একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদির পূর্বে ১ নাম্বার ভিত্তি তথা আকীদা বিশ্বাসের যায়গাটি ঠিক করতে হবে। উক্ত হাদীসে তাওহিদের এই বিশ্বাসকে আমরা বলেছিলাম আকীদার নিউক্লিয়াস বা এটিই হলো আকীদা।
★ বিশ্বাসের কাঠামো প্রসঙ্গে ইমামদের বক্তব্য নিম্মরুপ-
# ইমাম আবু হানিফা (র) এর মতে- আন্তরিক বিশ্বাসের নাম ঈমান। মুখের স্বীকারোক্তি এবং আমল হলো ঈমানের পরিপূরক।
# ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক ও ইমাম ইবনে হাম্বল (র) এর মতে- আন্তরিক বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকারোক্তি, কর্মে বাস্তবায়ন এর সমন্বিত রুপ হলো ঈমান। তবে উপাদান ও গুরুত্বের দিক থেকে সবগুলো সমান নয়। আন্তরিক বিশ্বাসই হলো মূল উপাদান।
প্রকৃতপক্ষে চার ইমামের মধ্যে এ বিষয়ে মৌলিক কোন বিরোধ নেই। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বিশ্বাসের কাঠামো হিসেবে চার ইমামের মতকেই গ্রহন করেছেন।
সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বর্ণনায়, রাসূল (স) বলেছেন; যে ব্যক্তি পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মদ (স) কে নবী হিসেবে মেনে নিয়েছে, সে ব্যক্তি ঈমানের প্রকৃত স্বাদ লাভ করেছে।
ইমামদের কথার সারমর্ম হলো- পরিশুদ্ধ ও আন্তরিক বিশ্বাসের নাম হলো ঈমান বা আকীদা। আর মৌখিক স্বীকারোক্তি ও কর্মে বাস্তবায়ন ঈমানের সম্পূরক।
আরো সহজভাবে বললে, মানুষের কাজসমূহ তার বিশ্বাস ও গুনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আমল হলো বান্দার আকীদা বা ঈমানের দৃঢ় বিশ্বাসের চুড়ান্ত ফলাফল। যার মাধ্যমে পরকালে সফলতার স্তর নির্ধারিত হবে। কিন্তু সফলতার স্তর যাইহোক না কেন, নুন্যতম সফলতার অংশীদার হতে হলেও সবকিছুর আগে ঈমান বা আকীদার পরিশুদ্ধতা আবশ্যক।
..............চলবে।
আকীদা (ঈমান): পর্ব-০১
https://alor-moshal.blogspot.com/2020/06/blog-post.html
Comments
Post a Comment