কুরআনের দৃষ্টিতে সফল যারা (২য় পর্ব)

এইচ.এম নূর আলম ফয়সাল
৮. যারা সর্বাবস্থায় দান করে:
৯. যারা ক্রোধ ধমন করে:
১০. যারা ক্ষমাশীল:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ–ত্রুটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন।" (ইমরান-১৩৪)

নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বিচার করলে একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সুদ আসলে স্বার্থপরতা, কৃপণতা, সংকীর্ণতা, নির্মমতা ইত্যাকার অসৎ গুণাবলীর ফল এবং এই গুণগুলোই সুদকে মানুষের মধ্যে বিকশিত করে। অন্যদিকে দানশীলতা, সহানুভূতি, উদারতা ও মহানুভবতা ইত্যাকার গুণাবলীই দান-খয়রাতের জন্ম দেয়। আর নিয়মিত দান-খয়রাত করতে থাকলে এই গুণগুলো মানুষের মধ্যে লালিত ও বিকশিত হতেও থাকে। এমন কে আছে যে, এই উভয় ধরনের নৈতিক গুণাবলীর মধ্য থেকে প্রথমগুলোকে নিকৃষ্ট ও শেষেরগুলোকে উৎকৃষ্ট বলবে না?

১১. যারা সবর করে: 
১২. যারা হকের খেদমত করে:
১৩. যারা বাতিলের মোকাবেলায় দৃঢ় থাকে: 
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " হে ঈমানদারগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও, হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।" (ইমরান-২০০)
অর্থাৎ কাফেররা কুফরীর ব্যাপারে যে দৃঢ়তা ও অবিচলতা দেখাচ্ছে এবং কুফরীর ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য যে ধরনের কষ্ট স্বীকার করছে তোমরা তাদের মোকাবিলায় তাদের চাইতেও বেশী দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতী দেখাও।
তাদের মোকাবেলায় তোমরা দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতী দেখাবার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করো।

হকের খেদমত তথা আল্লাহর রাস্তায় যথাযথ প্রচেষ্টার ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে- "হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর দরবারে নৈকট্য লাভের উপায় অনুসন্ধান করো এবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো, সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে।" (মায়েদা-৩৫)

সবরের সাথে বাতিলের মোকাবেলায় দৃঢ়তার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- (তোমরা বলো) “হে আমাদের রব! আমাদের সবর দান করো, আমাদের অবিচলিত রাখ এবং এই কাফের দলের ওপর আমাদের বিজয় দান করো।” (বাকারা-২৫০)

১৪. যারা বাতিলের মোকাবেলায় আল্লাহর প্রতি নির্ভর করে: 
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়, তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে। আশা করা যায়, এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করবে।" (আনফাল-৪৫)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
“একথা আল্লাহ তোমাদের এ জন্য জানিয়ে দিলেন যে, তোমরা এতে খুশী হবে এবং তোমাদের মন আশ্বস্ত হবে। বিজয় ও সাহায্য সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত ও মহাজ্ঞানী”। (ইমরান-১২৬)
বাতিলের মোকাবেলায় বিজয় অর্জন কখনোই সংখ্যা ও সরঞ্জামের উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে আল্লাহর সাহায্যের উপর। আল্লাহর সাহাজ্য না আসলে সংখ্যাধিক্য হয়েও বিজয় লাভ করা যাবে না। আর আল্লাহর সাহাজ্য থাকলে বাতিলের মোকাবেলায় সংখ্যালঘু হয়েও বিজয় লাভ করা যায়।
দৃঢ়পদ থেকে আল্লাহর সাহায্যের জন্য প্রয়োজন সবর ও তাকওয়া। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন- "অবশ্যি, যদি তোমরা সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে যে মুহূর্তে দুশমন তোমাদের ওপর চড়াও হবে ঠিক তখনি তোমাদের রব (তিন হাজার নয়) পাঁচ হাজার চিহ্নযুক্ত ফেরেশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।" (ইমরান-১২৫)

১৫. যারা মহান রবের অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী:
"আল্লাহ তায়ালা বলেন- তোমরা কি এ জন্য অবাক হচ্ছো যে, তোমাদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তোমাদেরই স্বগোত্রীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে তোমাদের রবের স্মারক তোমাদের কাছে এসেছে? ভুলে যেয়ো না, তোমাদের রব নূহের সম্প্রদায়ের পর তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ও সুঠামদেহের অধিকারী করেন। কাজেই আল্লাহর অপরিসীম শক্তির কথা স্মরণ রাখো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।" (আরাফ-৬৯)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন-
"তারপর যখন নামায শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।" (জুমুয়া-১০)

১৬. যারা তাওবা করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।" (নুর-৩১)
বান্দা ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভূল করার পর তা বুঝতে পেরেও যারা তাওবা করে ফিরে আসে না তারা খুবই হতভাগ্য। আর যারা ভুল করার পর তা থেকে ফিরে আসে তখন আল্লাহ খুশী হয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং সফলকামীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে দেন
আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তবে তাদের মধ্য থেকে যারা তাওবা করবে, নিজেদের কর্মনীতি সংশোধন করে নেবে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং নিজেদের দ্বীনকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নেবে, তারা মুমিনদের সাথে থাকবে। আর আল্লাহ নিশ্চিয়ই মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দান করবেন”। (নিসা-১৪৬)


১৭. যারা বিচার ফয়সালায় আল্লাহ ও রাসুলের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "মু’মিনদের কাজই হচ্ছে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রসূল তাদের মোকদ্দমার ফায়সালা করেন, তখন তারা বলেন, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। এ ধরনের লোকেরাই সফলকাম হবে।" (নুর-৫১)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- "আর সফলকাম তারাই যারা আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মেনে চলে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে।"(নুর-৫২)
রাসূল (স) বলেন- তোমরা কেউই ততক্ষন পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষন না নিজের যাবতীয় কামনা বাসনাকে আমার আনীত বিধানের অধীন করবে।" (শরহে সুন্নাহ)
অর্থাৎ বিচার ফায়সালা সহ জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহর রাসুলের প্রণীত বিধানকেই মেনে চলতে হবে।

১৮. যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে:
রাসূল (স) এর যুগে মুখে সবাই জিহাদের কথা বললেও যখন জিহাদের আদেশ আসতো তখন দূর্বল ইমান ও মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা রাসুল (স) এর কাছে বিভিন্ন ওজর পেশ করে জিহাদ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতো। তাদের ব্যাপারে ও যারা জিহাদের আদেশ আসার সাথে সাথে রাসুলের সাথে জিহাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন -
" অন্যদিকে রসূল ও তার ঈমানদার সাথীরা নিজেদের জান-মাল দিয়ে জিহাদ করেছে। সমস্ত কল্যাণ এখন তাদের জন্য এবং তারাই সফলকাম হবে।" (তাওবা- ৮৮)
"আল্লাহ তাদের জন্য এমন বাগান তৈরী করে রেখেছেন। যার নিম্নদেশে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত হচ্ছে। তার মধ্যে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই মহা সাফল্য।" (তাওবা-৮৯)

"গ্রামীণ আরবের মধ্যে থেকেও অনেক লোক এলো। তারা ওযর পেশ করলো, যাতে তাদেরকেও পিছনে থেকে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। যারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে ঈমানের মিথ্যা অঙ্গীকার করেছিল তারাই এভাবে বসে রইল। এ গ্রামীণ আরবদের মধ্য থেকে যারাই কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে শীঘ্রই তারা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি ভোগ করবে।" (তাওবা- ৯০)
অর্থাৎ মুনাফিক সুলভ তথা ভণ্ডামী পূর্ণ ঈমানের প্রকাশ, যার ভেতরে নেই সত্যের যথার্থ স্বীকৃতি, আত্মসমর্পণ, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও আনুগত্য এবং যার বাহ্যিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও মানুষ আল্লাহ ও তার দ্বীনের তুলনায় নিজের স্বার্থ এবং পার্থিব মোহ ও আশা-আকাংখাকে প্রিয়তর মনে করে। এ ধরনের ঈমান প্রকৃতপক্ষে কুফরী ও অস্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। দুনিয়ার এ ধরনের লোকদেরকে কাফের গণ্য না করা এবং তাদের সাথে মুসলমানের মতো ব্যবহার করা হলেও আল্লাহর দরবারে তাদের সাথে অবাধ্য অস্বীকারকারী ও বিদ্রোহীদের মতো, আচরণ করা হবে। এ পার্থিব জীবনে মুসলিম সমাজের ভিত্তি যে আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ বিধানের ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্র ও তার বিচারক আইন প্রয়োগ করেন তার প্রেক্ষিতে মুনাফিকীকে কুফরী বা কুফরী সদৃশ কেবল তখনই বলা যেতে পারে যখন অস্বীকৃতি, বিদ্রোহ বিশ্বসঘাতকতা ও অবিশ্বস্ততার প্রকাশ সুস্পষ্টভাবে হবে। তাই মুনাফিকীর এমন অনেক ধরন ও অবস্থা থেকে যায় শরীয়াতের বিচারে যেগুলোকে কুফরী নামে অভিহিত করা যায় না। কিন্তু শরীয়াতের বিচারে কোন মুনাফিকের কুফরীর অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহর বিচারেও সে এ অভিযোগের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবে। (তাফহীম)

১৯. যারা আত্মীয় ও মিসকিনের অধিকার আদায় করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " কাজেই (হে মুমিন!) আত্মীয়দেরকে তাদের অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফির কে (দাও তাদের অধিকার) । এ পদ্ধতি এমন লোকদের জন্য ভালো যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই এবং তারাই সফলকাম হবে।" (রুম- ৩৮)
এখানে আত্মীয়-স্বজন, মিসকিন ও মুসাফিরদেরকে দান করার কথা বলা হয়নি। বরং বলা হচ্ছে, এ তাঁর অধিকার এবং অধিকার মনে করেই তোমাদের এটা দেয়া উচিত। এ অধিকার দিতে গিয়ে তোমার মনে এ ধারণা না জন্মে যে, তাঁর প্রতি তুমি অনুগ্রহ করছো এবং তুমি কোনো মহান দানশীল সত্ত্বা আর সে কোন একটি সামান্য ও নগণ্য সৃষ্টি, তোমার অনুগ্রহের কণা ভক্ষণ করেই সে জীবিকা নির্বাহ করে। বরং একথা ভালোভাবে তোমার মনে গেঁথে যাওয়া উচিত যে, সম্পদের আসল মালিক যদি তোমাকে বেশি এবং অন্য বান্দাদেরকে কম দিয়ে থাকেন, তাহলে এ বর্ধিত সম্পদ হচ্ছে এমন সব লোকের অধিকার যাদেরকে তোমার আওতাধীনে তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য দেয়া হয়েছে। তুমি তাদেরকে এ অধিকার দান করছো কি করছো না এটা তোমার মালিক দেখতে চান। (তাফহীম)

#HMNAF

Comments

পপুলার পোস্ট

দারসুল কুরআন| রবের শ্রেষ্ঠত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের আহ্বানে করনীয় | সূরা মুদ্দাসসির (১-৭)

দারসুল কুরআনঃ ইসলামী আন্দোলন ও বাইয়াতের গুরুত্ব | এইচ.এম নুর আলম ফয়সাল|আলোর মশাল ব্লগ

দারসুল হাদীস : পাচটি বিষয়ের নির্দেশ