কুরআনের দৃষ্টিতে সফল যারা (১ম পর্ব)
এইচ.এম নুর আলম ফয়সাল
সফলতার মানদন্ড একেকজনের কাছে একেকরকম। কেউ টাকা, কেউ উচ্চতর ডিগ্রি, কেউ ক্ষমতা, কেউ সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদিকেই নিজেদের সফলতার মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করে। হ্যাঁ, পৃথিবীতে চলতে ফিরতে এসবের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। তবে এসব বস্তুগত সফলতা শুধুমাত্র দুনিয়ার জন্যই নিহিত। দুনিয়া এবং পরকালে তথা উভয় জাহানের সফলতার মানদন্ড বুঝে তার আলোকে নিজেকে গঠন করতে পারাই প্রকৃত সফলতা। সেজন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দৃষ্টিতে প্রকৃতপক্ষে সফল কারা তা আমাদের জানতে হবে।
পরকালে সফলতার মানদন্ডের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর সেদিন যথার্থই ওজন হবে। অতঃপর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে। (আরাফ-০৮)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- " তারপর যখনই শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তাদের মধ্যে আর কোন আত্মীয়তা বা সম্পর্ক থাকবে না এবং তারা পরস্পরকে জিজ্ঞেসও করবে না। সে সময় যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হাল্কা হবে তারাই হবে এমনসব লোক যারা নিজেদেরকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তারা জাহান্নামে থাকবে চিরকাল।" (মুমিনুন- ১০১-১০৩)
তাই কোনভাবেই পরকালীন সফলতার কথা ভূলে গিয়ে শুধুমাত্র দুনিয়ায় মত্ত হলে চলবে না, বরং যে ব্যক্তি পরকালীন সফলতাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন পরিচালনা করবে তার পরকাল যেমন সাফল্যমণ্ডিত হবে তেমনি দুনিয়াও হবে সাফল্যমণ্ডিত। আজকে আমরা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালার দেওয়া সফলতার কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুনাগুন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
আল্লাহর কাছে বা কুরআনে দৃষ্টিতে যারা সফল তাদের বিবরন নিম্মরুপঃ
১. যারা রবের পক্ষ থেকে দেওয়া সত্যের অনুসারী:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "যেসকল লোকেরা তাদের রবের পক্ষ থেকে সরল সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত তারাই সফলতার অধিকারী"। (বাকারা-৫, লোকমান-৫)
যে সময় এ আয়াত নাযিল হয় তখন মক্কার কাফেররা মনে করতো এবং প্রকাশ্যে বলতো যে, মুহাম্মাদ (স) এবং তাঁর এ দাওয়াত গ্রহণকারী লোকেরা নিজেদের জীবন ধ্বংস করে চলছে। তাই একেবারে নির্দিষ্ট করে এবং পুরোপুরি জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “এরাই সফলকাম হবে॥” অর্থাৎ এরা ধ্বংস হবে না, যেমন বাজে ও উদ্ভট চিন্তার মাধ্যমে তোমরা মনে করে বসেছো। বরং এরাই আসলে সফলকাম হবে এবং যারা এপথ অবলম্বন করতে অস্বীকার করেছে তারাই হবে অকৃতকার্য।
২. যারা বিতর্ক ছাড়াই আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো। শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্যই ভালো। যে মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকলো সেই সফলতা লাভ করবে।" (তাগাবুন-১৬)
" হে নবী! এদেরকে বলে দাও, পবিত্র ও অপবিত্র সমান নয়, অপবিত্রের আধিক্য তোমাদের যতই চমৎকৃত করুক না কেন। কাজেই হে বুদ্ধিমানেরা! আল্লাহর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকো আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।" (মায়েদা-১০০)
"লোকেরা তোমাকে চাঁদ ছোট বড়ো হওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে। বলে দাওঃ এটা হচ্ছে লোকদের জন্য তারিখ নির্ণয় ও হজ্জ্বের আলামত তাদেরকে আরো বলে দাওঃ তোমাদের পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করার মধ্যে কোন নেকী নেই। আসলে নেকী রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার মধ্যেই, কাজেই তোমরা দরজা পথেই নিজেদের গৃহে প্রবেশ করো। তবে আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, হয়তো তোমরা সাফল্য লাভে সক্ষম হবে।" (বাকারা-১৮৯)
আর যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে তারা কখনোই সফলকাম হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- " আর তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করে অথবা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে? অবশ্যি এ ধরনের জালেমরা কখনই সফলকাম হতে পারে না।
( আনআম-২১)
আর পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর কথা মেনে নিবে তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে- “এখন যারা আল্লাহর কথা মেনে নেবে এবং তার আশ্রয় খুঁজবে তাদেরকে আল্লাহ নিজের রহমত, করুণা ও অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নেবেন এবং নিজের দিকে আসার সোজাপথ দেখিয়ে দেবেন”।(নিসা-১৭৫)
৩. যারা যথাযথভাবে রাসূল (স) এর আনুগত্য করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " যারা এ প্রেরিত উম্মী নবীর আনুগত্য করে, যার উল্লেখ এখানে তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সে তাদের সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে, তাদের জন্য পাক পবিত্র জিনিসগুলো হালাল ও নাপাক জিনিসগুলো হারাম করে এবং তাদের ওপর থেকে এমন সব বোঝা নামিয়ে দেয়। যা তাদের ওপর চাপানো ছিল আর এমন সব বাঁধন থেকে তাদেরকে মুক্ত করে যাতে তারা আবদ্ধ ছিল। কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সাহায্য সহায়তা দান করে এবং তার সাথে অবতীর্ণ আলোক রশ্মির অনুসরণ করে তারাই সফলতা লাভের অধিকারী। (আরাফ-১৫৭)
অর্থাৎ যারা রাসূল (স) এর প্রতি বিশ্বাষ স্থাপন করবে এবং রাসুল (স) এর অনুসৃত কাজ সম্পাদন করেবে ও তার ওপর অবতীর্ণ তথা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের যথাযথ অনুসরণ করবে তারাই সফলকাম হবে।
রাসূল (স) বলেন- " তোমাদের মধ্যে কেউই আকাংখিত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষন না সে নিজের প্রবৃত্তিকে আমার আনীত বিধানের অধীন করে।" (শরহে সুন্নাহ)
৪. যারা রবের বন্দেগী করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "হে ঈমানদারগণ! রুকূ’ ও সিজদা করো, নিজের রবের বন্দেগী করো এবং নেক কাজ করো, হয়তো তোমাদের ভাগ্যে সফলতা আসবে।" (হজ্জ-৭৭)
অর্থাৎ এ নীতি অবলম্বন করলে সফলতার আশা করা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি এ নীতি অবলম্বন করবে তার নিজের কার্যক্রমের ব্যাপারে এমন অহংকার থাকা উচিত নয় যে, সে যখন এত বেশী ইবাদাতগুজার ও নেককার তখন সে নিশ্চয়ই সফলকাম হবে। বরং তার আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থী হওয়া এবং তাঁরই রহমতের সাথে সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা বিজড়িত করা উচিত। তিনি সফলতা দান করলেই কোন ব্যক্তি সফলতা পেতে পারে। নিজে নিজেই সফলতা লাভ করার সামর্থ্য কারো নেই।
আল্লাহর বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন বস্তুর উপাসনা করে কেউ সফলকাম হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- " এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কোন মাবুদকে ডাকে, যার পক্ষে তার কাছে কোন যুক্তি প্রমাণ নেই, তার হিসেব রয়েছে তার রবের কাছে। এ ধরনের কাফের কখনো সফলকাম হতে পারে না। (মুমিনুন-১১৭)
৫. যারা আল্লাহ ও রাসুল (স) এর ভালোবাসাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদের ভালবাসছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করেছে। তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র অথবা ভাই অথবা গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। আল্লাহ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ‘রূহ’ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহর দলের লোকেরাই সফলকাম।" (মুজাদিলাহ-২২)
এ আয়াতে দুইটি কথা বলা হয়েছে। একটি নীতি কথা। অন্যটি প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা। নীতি কথায় বলা হয়েছে যে, সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান এবং দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা দু’টি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী জিনিস। এ দু’টি জিনিসের একত্র সমাবেশ বা অবস্থান কোনভাবে কল্পনাও করা যায় না। ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রুদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব একই হৃদয়ে একত্রিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কোন মানুষের হৃদয়ে যখন একই সাথে নিজের প্রতি ভালবাসা এবং শত্রুর প্রতি ভালবাসা একত্রিত হতে পারে না তখন এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যাপার। অতএব তোমরা যদি কাউকে দেখো, সে ঈমানের দাবীও করে এবং সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী লোকদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও রাখে তাহলে তোমাদর মনে কখনো যেন এ ভুল ধারণা না জন্মে যে, এ আচরণ সত্ত্বেও সে তার ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী। অনুরূপ যেসব লোক একই সাথে ইসলাম ও ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে সে নিজেও যেন তার এ অবস্থান ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখে যে, প্রকৃতপক্ষে সে কি, মু’মিন না মুনাফিক? সে প্রকৃতপক্ষে কি হতে চায়, মু’মিন হয়ে থাকতে চায়, নাকি মুনাফিক হয়ে ? তার মধ্যে যদি সততার লেশমাত্রও থেকে থাকে এবং মুনাফিকীর আচরণ যে নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের জন্য নিকৃষ্টতম আচরণ এ বিষয় তার মধ্যে সামান্যতম অনূভূতিও থাকে তা হলে তার উচিত একই সাথে দুই নৌকায় আরোহণের চেষ্টা পরিত্যাগ করা। ঈমান এ ব্যাপারে তার কাছে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দাবী করে। সে যদি মু’মিন থাকতে চায় তাহলে যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন ইসলামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধনের সাথে সাংঘর্ষিক তার সবই তাকে বর্জন করতে হবে। ইসলামের সাথে সম্পর্কের চাইতে অন্য কোন সম্পর্ক প্রিয়তর হয়ে থাকলে ঈমানের মিথ্যা দাবী ছেড়ে দেয়াই উত্তম। (তাফহীম)
এ ব্যাপারে রাসুল (স) বলেন- " যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই হয়ে থাকে। সে ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদান।" (বুখারী)
আর যারা আল্লাহ ও রাসুল (স) এর উপর অন্য কাউকে ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়েছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- "আর যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তাঁর পথে সংগ্রাম করার চাইতে তোমাদের কাছে এসব বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না। (তাওবা- ২৪)
৬. যারা মানুষদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে।" (ইমরান-১০৪)
রাসূল (সাঃ) এ আয়াত তেলাওয়াত করে বলেছিলেন এ সম্প্রদায় হলো বিশেষ করে সাহাবা কেরামের দল (ইবনে কাসীর)।
এখন সাহাবাদের অনুসারীরাই সেই দল। কারন কোরআনের নির্দেশ সার্বজনীন। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ঈমানদার পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের অধিকাংশই নাফরমান”।(ইমরান-১১০)
৭. যারা মদ, জুয়া ইত্যাদি শয়তানি কাজ থেকে দূরে থাকে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ, এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে।" (মায়েদা-৯০)
এ আয়াতে চারটি জিনিস চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এক, মদ। দুই, জুয়া। তিন, এমন সব জায়গা যেগুলোকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করার অথবা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য কুরবানী করার ও নজরানা দেবার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। চার, ভাগ্য নির্ণায়ক শর। অর্থাৎ যারা এ চারটি ঘৃণ্য শয়তানি কার্যকলাপে লিপ্ত থাকবে তারা কখনোই সফল হতে পারবে না।
#HMNAF
....................................................চলবে
সফলতার মানদন্ড একেকজনের কাছে একেকরকম। কেউ টাকা, কেউ উচ্চতর ডিগ্রি, কেউ ক্ষমতা, কেউ সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদিকেই নিজেদের সফলতার মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করে। হ্যাঁ, পৃথিবীতে চলতে ফিরতে এসবের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। তবে এসব বস্তুগত সফলতা শুধুমাত্র দুনিয়ার জন্যই নিহিত। দুনিয়া এবং পরকালে তথা উভয় জাহানের সফলতার মানদন্ড বুঝে তার আলোকে নিজেকে গঠন করতে পারাই প্রকৃত সফলতা। সেজন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দৃষ্টিতে প্রকৃতপক্ষে সফল কারা তা আমাদের জানতে হবে।
পরকালে সফলতার মানদন্ডের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- আর সেদিন যথার্থই ওজন হবে। অতঃপর যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই সফলকাম হবে। (আরাফ-০৮)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- " তারপর যখনই শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখন তাদের মধ্যে আর কোন আত্মীয়তা বা সম্পর্ক থাকবে না এবং তারা পরস্পরকে জিজ্ঞেসও করবে না। সে সময় যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই সফলকাম হবে। আর যাদের পাল্লা হাল্কা হবে তারাই হবে এমনসব লোক যারা নিজেদেরকে ক্ষতির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তারা জাহান্নামে থাকবে চিরকাল।" (মুমিনুন- ১০১-১০৩)
তাই কোনভাবেই পরকালীন সফলতার কথা ভূলে গিয়ে শুধুমাত্র দুনিয়ায় মত্ত হলে চলবে না, বরং যে ব্যক্তি পরকালীন সফলতাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন পরিচালনা করবে তার পরকাল যেমন সাফল্যমণ্ডিত হবে তেমনি দুনিয়াও হবে সাফল্যমণ্ডিত। আজকে আমরা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালার দেওয়া সফলতার কিছু বৈশিষ্ট্য বা গুনাগুন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
আল্লাহর কাছে বা কুরআনে দৃষ্টিতে যারা সফল তাদের বিবরন নিম্মরুপঃ
১. যারা রবের পক্ষ থেকে দেওয়া সত্যের অনুসারী:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "যেসকল লোকেরা তাদের রবের পক্ষ থেকে সরল সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত তারাই সফলতার অধিকারী"। (বাকারা-৫, লোকমান-৫)
যে সময় এ আয়াত নাযিল হয় তখন মক্কার কাফেররা মনে করতো এবং প্রকাশ্যে বলতো যে, মুহাম্মাদ (স) এবং তাঁর এ দাওয়াত গ্রহণকারী লোকেরা নিজেদের জীবন ধ্বংস করে চলছে। তাই একেবারে নির্দিষ্ট করে এবং পুরোপুরি জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “এরাই সফলকাম হবে॥” অর্থাৎ এরা ধ্বংস হবে না, যেমন বাজে ও উদ্ভট চিন্তার মাধ্যমে তোমরা মনে করে বসেছো। বরং এরাই আসলে সফলকাম হবে এবং যারা এপথ অবলম্বন করতে অস্বীকার করেছে তারাই হবে অকৃতকার্য।
২. যারা বিতর্ক ছাড়াই আল্লাহর নির্দেশ মান্য করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো। শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো। এটা তোমাদের জন্যই ভালো। যে মনের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকলো সেই সফলতা লাভ করবে।" (তাগাবুন-১৬)
" হে নবী! এদেরকে বলে দাও, পবিত্র ও অপবিত্র সমান নয়, অপবিত্রের আধিক্য তোমাদের যতই চমৎকৃত করুক না কেন। কাজেই হে বুদ্ধিমানেরা! আল্লাহর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকো আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।" (মায়েদা-১০০)
"লোকেরা তোমাকে চাঁদ ছোট বড়ো হওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে। বলে দাওঃ এটা হচ্ছে লোকদের জন্য তারিখ নির্ণয় ও হজ্জ্বের আলামত তাদেরকে আরো বলে দাওঃ তোমাদের পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করার মধ্যে কোন নেকী নেই। আসলে নেকী রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার মধ্যেই, কাজেই তোমরা দরজা পথেই নিজেদের গৃহে প্রবেশ করো। তবে আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, হয়তো তোমরা সাফল্য লাভে সক্ষম হবে।" (বাকারা-১৮৯)
আর যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে তারা কখনোই সফলকাম হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- " আর তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করে অথবা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে? অবশ্যি এ ধরনের জালেমরা কখনই সফলকাম হতে পারে না।
( আনআম-২১)
আর পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর কথা মেনে নিবে তাদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে- “এখন যারা আল্লাহর কথা মেনে নেবে এবং তার আশ্রয় খুঁজবে তাদেরকে আল্লাহ নিজের রহমত, করুণা ও অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নেবেন এবং নিজের দিকে আসার সোজাপথ দেখিয়ে দেবেন”।(নিসা-১৭৫)
৩. যারা যথাযথভাবে রাসূল (স) এর আনুগত্য করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " যারা এ প্রেরিত উম্মী নবীর আনুগত্য করে, যার উল্লেখ এখানে তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সে তাদের সৎকাজের আদেশ দেয়, অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে, তাদের জন্য পাক পবিত্র জিনিসগুলো হালাল ও নাপাক জিনিসগুলো হারাম করে এবং তাদের ওপর থেকে এমন সব বোঝা নামিয়ে দেয়। যা তাদের ওপর চাপানো ছিল আর এমন সব বাঁধন থেকে তাদেরকে মুক্ত করে যাতে তারা আবদ্ধ ছিল। কাজেই যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সাহায্য সহায়তা দান করে এবং তার সাথে অবতীর্ণ আলোক রশ্মির অনুসরণ করে তারাই সফলতা লাভের অধিকারী। (আরাফ-১৫৭)
অর্থাৎ যারা রাসূল (স) এর প্রতি বিশ্বাষ স্থাপন করবে এবং রাসুল (স) এর অনুসৃত কাজ সম্পাদন করেবে ও তার ওপর অবতীর্ণ তথা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের যথাযথ অনুসরণ করবে তারাই সফলকাম হবে।
রাসূল (স) বলেন- " তোমাদের মধ্যে কেউই আকাংখিত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষন না সে নিজের প্রবৃত্তিকে আমার আনীত বিধানের অধীন করে।" (শরহে সুন্নাহ)
৪. যারা রবের বন্দেগী করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "হে ঈমানদারগণ! রুকূ’ ও সিজদা করো, নিজের রবের বন্দেগী করো এবং নেক কাজ করো, হয়তো তোমাদের ভাগ্যে সফলতা আসবে।" (হজ্জ-৭৭)
অর্থাৎ এ নীতি অবলম্বন করলে সফলতার আশা করা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি এ নীতি অবলম্বন করবে তার নিজের কার্যক্রমের ব্যাপারে এমন অহংকার থাকা উচিত নয় যে, সে যখন এত বেশী ইবাদাতগুজার ও নেককার তখন সে নিশ্চয়ই সফলকাম হবে। বরং তার আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থী হওয়া এবং তাঁরই রহমতের সাথে সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা বিজড়িত করা উচিত। তিনি সফলতা দান করলেই কোন ব্যক্তি সফলতা পেতে পারে। নিজে নিজেই সফলতা লাভ করার সামর্থ্য কারো নেই।
আল্লাহর বন্দেগী ছাড়া অন্য কোন বস্তুর উপাসনা করে কেউ সফলকাম হতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- " এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কোন মাবুদকে ডাকে, যার পক্ষে তার কাছে কোন যুক্তি প্রমাণ নেই, তার হিসেব রয়েছে তার রবের কাছে। এ ধরনের কাফের কখনো সফলকাম হতে পারে না। (মুমিনুন-১১৭)
৫. যারা আল্লাহ ও রাসুল (স) এর ভালোবাসাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদের ভালবাসছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরোধিতা করেছে। তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র অথবা ভাই অথবা গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। আল্লাহ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ‘রূহ’ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহর দলের লোকেরাই সফলকাম।" (মুজাদিলাহ-২২)
এ আয়াতে দুইটি কথা বলা হয়েছে। একটি নীতি কথা। অন্যটি প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা। নীতি কথায় বলা হয়েছে যে, সত্য দ্বীনের প্রতি ঈমান এবং দ্বীনের শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা দু’টি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী জিনিস। এ দু’টি জিনিসের একত্র সমাবেশ বা অবস্থান কোনভাবে কল্পনাও করা যায় না। ঈমান এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের শত্রুদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্ব একই হৃদয়ে একত্রিত হওয়া একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কোন মানুষের হৃদয়ে যখন একই সাথে নিজের প্রতি ভালবাসা এবং শত্রুর প্রতি ভালবাসা একত্রিত হতে পারে না তখন এটাও ঠিক অনুরূপ ব্যাপার। অতএব তোমরা যদি কাউকে দেখো, সে ঈমানের দাবীও করে এবং সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী লোকদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও রাখে তাহলে তোমাদর মনে কখনো যেন এ ভুল ধারণা না জন্মে যে, এ আচরণ সত্ত্বেও সে তার ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী। অনুরূপ যেসব লোক একই সাথে ইসলাম ও ইসলাম বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে সে নিজেও যেন তার এ অবস্থান ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখে যে, প্রকৃতপক্ষে সে কি, মু’মিন না মুনাফিক? সে প্রকৃতপক্ষে কি হতে চায়, মু’মিন হয়ে থাকতে চায়, নাকি মুনাফিক হয়ে ? তার মধ্যে যদি সততার লেশমাত্রও থেকে থাকে এবং মুনাফিকীর আচরণ যে নৈতিক দিক দিয়ে মানুষের জন্য নিকৃষ্টতম আচরণ এ বিষয় তার মধ্যে সামান্যতম অনূভূতিও থাকে তা হলে তার উচিত একই সাথে দুই নৌকায় আরোহণের চেষ্টা পরিত্যাগ করা। ঈমান এ ব্যাপারে তার কাছে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দাবী করে। সে যদি মু’মিন থাকতে চায় তাহলে যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন ইসলামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধনের সাথে সাংঘর্ষিক তার সবই তাকে বর্জন করতে হবে। ইসলামের সাথে সম্পর্কের চাইতে অন্য কোন সম্পর্ক প্রিয়তর হয়ে থাকলে ঈমানের মিথ্যা দাবী ছেড়ে দেয়াই উত্তম। (তাফহীম)
এ ব্যাপারে রাসুল (স) বলেন- " যে ব্যক্তির ভালোবাসা ও শত্রুতা, দান করা ও না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই হয়ে থাকে। সে ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদান।" (বুখারী)
আর যারা আল্লাহ ও রাসুল (স) এর উপর অন্য কাউকে ভালোবাসার প্রাধান্য দিয়েছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- "আর যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তাঁর পথে সংগ্রাম করার চাইতে তোমাদের কাছে এসব বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না। (তাওবা- ২৪)
৬. যারা মানুষদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- "তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে।" (ইমরান-১০৪)
রাসূল (সাঃ) এ আয়াত তেলাওয়াত করে বলেছিলেন এ সম্প্রদায় হলো বিশেষ করে সাহাবা কেরামের দল (ইবনে কাসীর)।
এখন সাহাবাদের অনুসারীরাই সেই দল। কারন কোরআনের নির্দেশ সার্বজনীন। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন-
“এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ঈমানদার পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের অধিকাংশই নাফরমান”।(ইমরান-১১০)
৭. যারা মদ, জুয়া ইত্যাদি শয়তানি কাজ থেকে দূরে থাকে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন- " হে ঈমানদারগণ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ, এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকলাপ। এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে।" (মায়েদা-৯০)
এ আয়াতে চারটি জিনিস চূড়ান্তভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এক, মদ। দুই, জুয়া। তিন, এমন সব জায়গা যেগুলোকে আল্লাহ ছাড়া আর কারোর ইবাদাত করার অথবা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য কুরবানী করার ও নজরানা দেবার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। চার, ভাগ্য নির্ণায়ক শর। অর্থাৎ যারা এ চারটি ঘৃণ্য শয়তানি কার্যকলাপে লিপ্ত থাকবে তারা কখনোই সফল হতে পারবে না।
#HMNAF
....................................................চলবে
Comments
Post a Comment